মসুর ডালের জন্য জমি তৈরি

May 21, 2023
কৃষি সম্পর্কিত
মসুর ডালের জন্য জমি তৈরি

                     মসুর ডালের জন্য জমি তৈরি


মাটি ও জলবায়ু

সব ধরনের মাটিতেই মসুর চাষ করা যায়। তবে সুনিষ্কাশিত বেলে দোঁয়াশ মাটিতে এটি ভালো জন্মে। মসুর সাধারণত উষ্ণ তাপমাত্রায় ভালো জন্মে। কিন্তু অঙ্কুরোদগমের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ১৫-২০° সেন্টিগ্রেড। তাপমাত্রা এর চেয়ে নামলে অঙ্কুরোদগম এবং ফলন কম হয়। অন্য দিকে বীজের আকার ও এর অঙ্কুরোদগমের ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন বড় আকারের বীজের চেয়ে ছোট আকারের বীজ অপেক্ষাকৃত দ্রুত অঙ্কুরিত হয়।


জমি তৈরি: 

একক ফসল হিসেবে আবাদের ক্ষেত্রে জমিতে সুনিষ্কাশিত ও উপর্যুক্ত রস থাকলে ২-৩ বার পাওয়ার অথবা মিনিটিলার দিয়ে গভীর চাষ ও ৩-৪ বার মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।  মসুর আমন ধান কাটার পূর্বে রিলে ফসল হিসেবে আবাদ করা হলে চাষের প্রয়োজন  হয় না।

                               


বপনের সময়: 

ভালো ফলনের জন্য সঠিক সময়ে বীজ বপন করা প্রয়োজন। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত (কার্তিকের ২য় সপ্তাহ - কার্তিকের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত) বীজ বপনের উত্তম সময়। গবেষণায় দেখা যায় বপনের সময় প্রতি ১০ দিন বাড়ার সাথে সাথে ফলন ২০ ভাগ হারে কমতে থাকে। তবে বারি মসুর-৮ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বোনা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ফলন কিছুটা কমলেও রোগের কারণে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশংকা কম।


বীজ শোধন:

 ডাল জাতীয় ফসল বীজ বপনের পূর্বে শোধন করলে মাটি ও বীজ বাহিত অনেক জীবাণুর আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই মসুর বীজ বপনের পুর্বে অবশ্যই প্রোভেক্স-২০০ ডব্লিউ পি (কার্বোজিন+থিরাম) ২.৫ গ্রাম হারে প্রতি কেজি বীজে মিশিয়ে শোধন করলে শুরুতে গোড়া পচা রোগের প্রকোপ কমে যায়।


বপন পদ্ধতি:

মসুর সারিতে ও ছিটিয়ে এই দুই পদ্ধতিতে বপন করা যায়। তবে সারিতে বপন করলে পরিচর্যা করতে সুবিধা হয় এবং ফলন বেশি পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৩০ সেন্টিমিটার। মসুর বপনের সময় খেয়াল রাখতে হবে বীজগুলো যাতে মাটির কিছুটা নিচে পৌঁছে। এতে বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হয়, পাখি দ্বারা বীজ নষ্ট হয় না এবং বীজের অপচয় কম হয়।



বীজের হার: 

বীজের হার ৩০-৩৫ কেজি/হেক্টর। ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে বীজের পরিমাণ সামান্য বেশি দিতে হয়। তবে বারি মসুর-৩ এর বেলায় হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০কেজি বীজ ব্যবহার করতে হবে। বারি মসুর-৯ জাতের ক্ষেত্রে বীজ হার ৭০-৮০ কেজি/হেক্টর। তবে আমন ধানের সাথে সাথী ফসল (রিলে ক্রপ) হিসাবে আবাদ করলে ৫০-৬০ কেজি/ হেক্টর বীজ প্রয়োজন হয়।


সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি: 

মসুর একটি লেগুমিনাস বা শুঁটি ফসল হওয়ায় বাতাসের নাইট্রোজেনকে খাবার হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে বাজারের নাইট্রোজেন ঘটিত ইউরিয়া সার জমিতে কম পরিমাণে দিলেও চলে। যে জমিতে পূর্বে মসুর চাষ করা হয় নাই সেখানে প্রতি কেজি বীজের জন্য ৫০ গ্রাম হারে অনুমোদিত অণুজীব সার বীজের সাথে মিশিয়ে বপন করতে হবে। ইনোকুলাম ব্যবহার করলে সাধারণত ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হয় না।  


একক ফসলের জন্য অনুর্বর জমিতে হেক্টরপ্রতি নিম্ন লিখিত সারগুলি জমি শেষ চাষের সময় ব্যবহার করতে হবেঃ 


সারের নাম  

সারের পরিমাণ/হেক্টর(কেজি)

সারের পরিমাণ/বিঘা(কেজি)

ইউরিয়া

৪০-৪৫ 

  ৫-৬

টিএসপি 

৮০-৯০ 

১০-১৩

এমপি                                          


৩০-৪০ 

৪-৫

জিপসাম 

  ৫০-৫৫ 

৭-৮


বোরন (প্রয়োজনবোধে)

    ৭-১০ 

    ১-১.৫

অণুজীব সার(প্রয়োজনবোধে)

সুপারিশমতো 

সুপারিশমতো 

                                                     


পরিচর্যা

মসুরের ভালো ফলন পেতে হলে অঙ্কুরোদগমের ২০-৩০ দিন পর অবশ্যই আগাছা দমন করতে হবে। বীজ বপনের সময় মাটিতে খুব কম রস থাকলে বিশেষত বড় দানার মসুর বপনের আগেই হালকা সেচ দিতে হবে। কেননা, ছোট দানার মসুর অল্প আর্দ্রতায় অঙ্কুরিত হলেও বড় দানার মসুরের অঙ্কুরোদগমের জন্য বেশি আর্দ্রতার প্রয়োজন পড়ে। অন্য দিকে মসুর মোটেই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই কখনো অতি বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি জমলে দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।তবে মাটিতে রসের অভাবে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হলে গাছ গজানোর ৩০-৪০ দিনের মধ্যে একবার হালকা সেচ দিতে হবে।

                                                            


মসুর উৎপাদনে রাইজোবিয়াম অনুজিব সারের ব্যবহারঃ

ইউরিয়া সার ছাড়া সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ বেশি ফসল উৎপাদন করা যায়। রাইজোবিয়াম অণুজীব ও অন্যান্য বাহক পদার্থ দ্বারা অণুজীব সার তৈরি হয়, যাকে বায়োফার্টিলাইজার বা ইনোকুলাম বলে। ইনোকুলান্ট পাউডার, দানাদার ও তরল হতে পারে। সঠিক রাইজোবিয়ামকে ডাল ও তৈল জাতীয় ফসলের বীজ বা মূলের কাছাকাছি আনাকে ইনোকুলেশন বলে। বিভিন্ন ফসলের জন্য বিভিন্ন অণুজীব আছে, যেমন: সয়াবিনের জন্য Bradyrhizobium japonicum, মসুরের জন্য Rhizobium leguminosarum bv. Viciae এবং বাদামের জন্য Bradyrhizobium sps. অণুজীব সারের প্রয়োজন হয়। বারির (BARI) মৃত্তিকা অণুজীবতত্ত্ব গবেষণাগারে বিভিন্ন ডাল ও তৈল জাতীয় ফসলের জন্য রাইজোবিয়ামের বাছাইকৃত ও ব্যবহার উপযোগী বিভিন্ন স্ট্রেইনসমূহ আছে। রাইজোবিয়াম অণুজীবের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো এ অণুজীব বায়বীয় নাইট্রোজেনকে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী নাইট্রোজেনে রূপান্তরিত করে। আমরা জানি, বাতাসে প্রায় ৭৯ শতাংশ নাইট্রোজেন আছে, যেটাকে আমরা সহজে গাছের গ্রহণ উপযোগী নাইট্রোজেনে রূপান্তরিত করাতে পারি এবং সেই সঙ্গে কৃষকের ডাল ও তৈল–জাতীয় ফসলের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন বাড়াতে পারি। যেমন মসুর ডাল হেক্টরে ১১৫ কেজি নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে, যা প্রায় ২৫০ কেজি/হেক্টর সমমানের ইউরিয়ার সারের সমান। মুগ ডালে হেক্টরে ১০৫ কেজি, চিনাবাদামে ১০৫ হেক্টরে ১৫০ কেজি নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে, যা যথাক্রমে ২২৪ ও ৩২৬ কেজি/হেক্টর সমমানের ইউরিয়ার সারের সমান। এই অণুজীব ব্যবহার করলে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কৃষকের ফলন বাড়ে কোনো ধরনের ইউরিয়া সার ব্যবহার ছাড়া (উৎস: মৃত্তিকাবিজ্ঞান গবেষণাগার ও গবেষণা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর)। এসব নতুন কৃষিপ্রযুক্তি যদি কৃষকের দোর গোড়ায় পৌঁছানো যায়, তাহলে কৃষকের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রযুক্তিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, সেই সঙ্গে সরকারের কোটি কোটি টাকার ইউরিয়া সার আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। এ ছাড়া গত এক দশকে সারা বিশ্বে জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে কৃষকেরা নানা ধরনের নতুন নতুন রোগবালাইয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন, এ কারণে কৃষকের দিন দিন উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাই সময় এসেছে কৃষি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিজ্ঞানী, সচেতন সমাজ, কৃষিবিষয়ক সাংবাদিক, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ, কৃষক ও কোম্পানি প্রতিনিধি এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়ে রাইজো অণুজীব প্রযুক্তি সমন্ধে আওয়াজ তোলা, তবে একদিকে সরকারের লাখ লাখ কোটি টাকার ইউরিয়া সার আমদানি করতে হবে না, অন্যদিকে বাংলাদেশের অসহায় কৃষক ইউরিয়া সার ব্যবহার ছাড়াই ডাল ও তৈল–জাতীয় শস্যে ৪০ শতাংশ অধিক ফলন উৎপাদন করতে পারবে। আমাদের একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, এসব রাইজো অণুজীব সার মাটির কোনো ক্ষতি করে না এবং পরিবেশবান্ধব। সরকারের ও কৃষকের অর্থ সাশ্রয়কারী, পরিবেশবান্ধব এবং কৃষকের জন্য অত্যন্ত উপকারী যাঁরা এসব প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়টি সবার দৃষ্টিগোচর করতে হবে। কৃষকের কাছেও এর গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। কৃষককে বোঝাতে হবে, যদি রাইজো অণুজীব ব্যবহার করা হয়, তাহলে ইউরিয়া সার তো লাগবেই না সেই সঙ্গে মুসরে ৩৩ কেজি, মুগে ৩০ কেজি এবং বাদামে ৪৩ কেজি বাড়তি ইউরিয়া সার মাটিতে যোগ হবে এবং ৪০ শতাংশ ফলন বেশি বাড়বে।


সমস্ত বিভাগ
ফ্ল্যাশ বিক্রয়
আজকের ডিল