সরিষা চাষের জন্য জমি তৈরি
চাষের মৌসুম :
বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির অবস্থা অনুসারে টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালী সরিষা, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭ ও বারি সরিষা-৮ এর বীজ মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য-কার্তিক মাস (অক্টোবর) পর্যন্ত বোনা যায৷ রাই-৫ এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ (মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে৷
দেশের উত্তরাঞ্চলও দক্ষিণাঞ্চলে যথাক্রমে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সরিষার বীজ বুনতে হয়৷ দেশের মধ্যাঞ্চলে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে বীজ বুনতে হয়৷ নেপাস জাতের সরিষা মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত বপন করা যায়৷
উপযুক্ত জলবায়ু :
তাপমাত্রাঃ মধ্যম থেকে কম ১৫-৩০ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ অধিক তাপ তেলের পরিমাণ কমিয়ে দেয়৷
বায়ুর আপেক্ষিক আর্দ্রতাঃ ৫০-৭০ডিগ্রি৷ বায়ুর আর্দ্রতা বাড়লে পোকা ও রোগ বিশেষত অল্টারনারিয়া পাতা ধসা ও জাত পোকার প্রকোপ বাড়ে৷
জীববৈচিত্র্যঃ সরিষার চাষ এলাকায় পর্যাপ্ত মৌমাছি থাকতে হবে৷ এতে সরিষার পরাগায়ন ভালো হয়৷ কীটনাশক প্রয়োগে মৌমাছি না আসলে ফসল কম হয়৷
বৃষ্টিপাতঃ কম বা বৃষ্টিহীন পরিবেশ সরিষা উৎপাদনের জন্যে ভালো৷
ঝড় বা শিলাবৃষ্টিঃ ঝড় বা শিলাবৃষ্টি সরিষার জন্য খুব ক্ষতিকর৷
অতিবৃষ্টিঃ মৌসুমের শুরুতে নভেম্বর মাসে ও শেষে ফেব্রুয়ারি মাসে অতিবৃষ্টি সরিষার জন্য খুব ক্ষতিকর হয়ে থাকে৷
মাটির ধরন :
উর্বর ও মধ্য উর্বর দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি সরিষা চাষের জন্যে উত্তম৷ মাটির বর্ণ গাঢ় ধূসর হওয়া ভালো৷ লালমাটি বা কাঁকড়যুক্ত মাটিতে সরিষার চাষ ভালো হয় না৷ মাটির অম্লমান ৬.০ থেকে ৭.০ এর মধ্যে থাকলে উত্তম৷ লোনা মাটিতে সরিষা ভালো হয় না৷ বর্ষায় পলি জমি এমন মাটি চাষের জন্যে ভালো৷ শুষ্ক অবস্থায় ফাটল ধরা মাটিতে সরিষা ভালো হয় না৷
উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি সরিষার জন্যে ভালো৷ আগাম পানি নিকাশ হলে মাঝারি নিচু জমিতে চাষ করা যায৷ উঁচু-নিচু জমিতে সরিষার চাষ করা যায় না৷ জমি উন্মুক্ত স্থানে হওয়া দরকার, যাতে সেখানে সারাদিন রোদ পড়ে৷ বর্ষাকালে প্রধানত বোনা আমন ও রোপা আমনের জমিতে শীতকালীন ফসল হিসেবে সরিষার চাষ করা হয়৷ এছাড়া আন্তঃফসল হিসেবে উর্বর জমিতে এবং ফল বাগানে সরিষার চাষ করা যায়৷
চাষের জন্য উপযুক্ত অঞ্চল:
বাংলাদেশে সরিষার প্রধান প্রধান উৎপাদন এলাকা হলো :
কুমিল্লা – চান্দিনা, দাউদকান্দি৷
চাঁদপুর মতলব, হাইমচর৷
ব্রাহ্মণবাড়িয়া – আখাউড়া, সরাইল৷
বৃহত্তর ঢাকা – ধামরাই, মুন্সিগঞ্জ৷
ফরিদপুর – সদর, শরীয়তপুর৷
পাবনা – বেরা, ফরিদপুর৷
চট্টগ্রাম – দক্ষিণ চট্টগ্রাম এলাকা৷
কক্সবাজার – সদর, রামু৷
যশোর – সদর ও সংলগ্ন এলাকা৷
কুষ্টিয়া – মিরপুর, দৌলতপুর৷
নেত্রকোনা – কোহনগঞ্জ, বারহাট্টা৷
জমি তৈরি পদ্ধতি
জমিতে ৪-৬টি চাষ মই দিয়ে তৈরি করতে হবে৷ চাষ কম হলে সরিষা বীজের অঙ্কুরোদগমে বিঘ্ন ঘটে৷ মাটির জো অবস্থায় জমি চাষ দিতে হবে৷ এতে মাটিতে ঢেলা থাকবে না, মাটি সমতল হবে৷ জমি চাষ করর সময় আগাছা ভালোভাবে বাছাই করতে হবে, যাতে ফসলে আগাছার প্রকোপ কম হয়৷ সরিষা জমির চাষ ১০-১২ সেন্টিমিটার গভীরে হওয়া দরকার৷ সরিষা জমিতে চাষ করার ফাঁকে ফাঁকে রোদ লাগতে হবে৷ পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ দিলে ২-৩টি চাষই যথেষ্ট, তবে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমি সমতল করতে হবে৷
বীজ বপন পূর্বে করণীয়
বীজ বপনের পূর্বে ভিটাভেক্স-২০০ অথবা ক্যান্টন দিয়ে (২-৩ গ্রাম ছত্রাক নাশক/ কেজি বীজ) বীজ শোধন করে বপন করতে হবে৷ বিনা সরিষার বীজ ব্যাভিষ্টিন (২.৫ গ্রাম/ কেজি) বা বেনলেট (১.৫ গ্রাম/ কেজি) দিয়ে শোধন করতে হবে৷
বীজ বপন
বীজ বপন পদ্ধতি: বাংলাদেশ প্রধানত সরিষার বীজ ছিটিয়ে বপন করা হয়৷ তবে সারিতে বীজ বপন করলে ফসলের পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়৷ অবশ্য সারিতে বীজ বুনতে কিছু অতিরিক্ত ব্যয় হয়৷
বীজের হার: প্রতি হেক্টর ৭-৮ কেজি, গাছ সংখ্যা প্রতি বর্গমিটারে ৪৫ থেকে ৬৫টি (গাছের ধরন অনুসারে)৷
সারির দূরত্ব: সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার৷
সার ব্যবস্থাপনা
সরিষা চাষে সার প্রয়োগ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ জাত, মাটি এবং মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সার দিতে হয়৷ ইউরিয়া সার অর্ধেক বপনের আগে এবং বাকি অর্ধেক গাছে ফুল আসার সময় উপরিপ্রয়োগ করতে হয়৷ সার উপরি-প্রয়োগের সময় মাটিতে রস থাকা বাঞ্ছনীয়৷ সারের পরিমাণ নিম্নরূপ
জমিতে নির্বাচিত হারে সুষম কম্পোস্ট দেওয়া হলে সেখানে সাধারণ গোবর বা খৈল দেওয়ার প্রয়োজন হয় না৷
সার প্রয়োগ পদ্ধতি :
ইউরিয়া বীজ বপনের ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ১-২ বার প্রয়োগ করতে হবে৷
ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগ প্রয়োগ করতে হবে৷
ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগের পূর্বে জমির আগাছা দমন করতে হবে৷
অর্ধেক ইউরিয়া ও অন্যসব সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে৷
ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হবে৷
সেচ ব্যবস্থাপনা
সোনালী সরিষা, বারি সরিষা ৬ (ধলি), বারি সরিষা ৭ ও বারি সরিষা ৬ উফশী জাতসমূহ পানি সেচ দিলে ফলন বেশি হয়৷ বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে (গাছে ফুল আসার আগে) প্রথম সেচ এবং ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে (ফল ধরার সময়) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে৷ বপনের সময় মাটিতে রস কম থাকলে চারা গজানো ১০-১৫ দিনের মধ্যে একটা হালকা সেচ দিতে হবে৷ সেচের নিশ্চয়তা থাকলে সার বেশি দিতে হবে। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় অনেক অত্যাধুনিক সেচ পাম্প রয়েছে
আগাছা দমন
বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার এবং ফুল আসার সময় একবার নিড়ানি দিতে হয়৷
(তথ্যসূত্রঃAgricare24.com)