বেগুনের বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার
বেগুনের ভাইরাসজনিত মোজাইক রোগ
লক্ষণঃ
এ রোগ হলে গাছে হলুদ ও গাঢ় সবুজ ছোপ ছোপ মোজাইক করা পাতা দেখা দেয় এবং পাতা কুঁকড়ে যায়।
ক্ষেত থেকে আক্রান্ত গাছ তুলে পুতে ফেলা/ ডাল কেটে দেয়া
জাব পোকা এ রোগের বাহক, তাই এদের দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড ১ মি.লি. / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
বেগুনের পাউডারী মিলডিউ রোগ
পাতা ও গাছের গায়ে সাদা পাউডারের মত দাগ দেখা যায়, যা ধীরে ধীরে সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে ।
আক্রান্ত বেশী হলে পাতা হলুদ বা কালো হয়ে মারা যায় ।
সম্ভব হলে গাছের আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করুন।
ক্ষেত পরিস্কার রাখুন এবং পানি নিস্কাষনের ভাল ব্যবস্থা রাখুন।
(ম্যানকোজেব+মেটালোক্সিল) গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: রিডোমিল গোল্ড ২ গ্রাম/ লিটার হারে অথবা সালফার ছত্রাক নাশক যেমন কুমুলাস ৪ গ্রাম বা গেইভেট বা মনোভিট বা থিওভিট ২ গ্রাম অথবা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাক নাশ যেমন: গোল্ডাজিম ০.৫ মিলি. বা এমকোজিম বা কিউবি বা চ্যামপিয়ন ২ গ্রাম/ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা ।
আক্রান্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ করবেন না
সুষম সার ব্যবহার করুন।
রোগ প্রতিরোধী জাত যেমন: বারি উদ্ভাবিত/ অন্যান্য উন্নত জাতের চাষ করুন।
বিকল্প পোষক যেমন: আগাছা পরিস্কার রাখুন।
বেগুনের হোয়াইট মোল্ড রোগ
ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়।
এতে পাতার বোটায়, কান্ডে ও ফলে সাদা তুলার মত বস্তু দেখা যায় ।
প্লাবন সেচের পরিবর্তে স্প্রিংলার সেচ দেয়া।
আক্রান্ত ফল,পাতা ও ডগা অপসারণ করা।
বীজ লাগানোর আগে গভীরভাবে চাষ দিয়ে জমি তৈরী করা । ৪. (মেনকোজেব+ ফেনামিডন)গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: সিকিউর ২ গ্রাম / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করা।
স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সেই সবজি খাবেন না বা বিক্রি করবেন না।
লাল মাটির ক্ষেত্রে চাষের পূর্বে জমিতে শতাংশ প্রতি ৪ কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করে জমি তৈরী করুন।
লাগানোর আগে প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: ব্যাভিস্টিন বা নোইন অথবা ৪ গ্রাম ট্রাইকোডারমা ভিরিডি মিশিয়ে ১৫-২০ মিনিট ধরে চারা শোধন করে নিন।
রৌদ্রযুক্ত উচু স্থানে বীজতলা তৈরী করুন।
বীজতলায় বীজ বপনের ১৫ দিন আগে শতাংশ প্রতি ৮৫ গ্রাম হারে স্ট্যাবল ব্লিচিং পাউডার ছাই বা বালির সাথে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিয়ে হালকা পানি দিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিন।
জমিতে চারা লাগানোর ১৫ দিন আগে শতাংশ প্রতি ৮৫ গ্রাম হারে স্ট্যাবল ব্লিচিং পাউডার ছাই বা বালির সাথে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিয়ে হালকা পানি দিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিন।
জমি তৈরি করার সময় শতাংশ প্রতি ১৩০ গ্রাম হারে কার্বোফুরান গ্রুপের কীটনাশক যেমন: ফুরাডান সারের সাথে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিন।
বেগুনের ফল বিকৃতি সমস্যা রোগ
কখনও কখনও ফলের আকার বিকৃতি ঘটে যার কারণে বেগুনের বাজার মূল্য কমে যায়।
এর কারণ এখনও জানা যায়নি।
জমিতে নিয়মিত সেচ দেওয়া।
সুষম সার ব্যবহার করা।
সঠিক দুরত্বে চারা রোপন করা।
বেগুনের ফল ফেটে যাওয়া সমস্যা রোগ
তাপমাত্রার দ্রত পরিবর্তন, অতি পানি ঘাটতির পর হঠাৎ সেচ দেওয়া বা গাছের শরীরবৃত্তীয় কারণে কখনও কখনও বেগুন ফেটে যায়।
এতে বেগুন খাবারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
জমিতে নিয়মিত সেচ দেওয়া।
সুষম সার ব্যবহার করা।
সঠিক দুরত্বে চারা রোপন করা।
খরার সময় হঠাৎ জমিতে সেচ প্রয়োগ করবেন না।
আগাম বীজ বপন করা।
নিয়মিত জমির আদ্রতা পরীক্ষা করে সেচ দিন।
বেগুনের কোনিফেরা ব্লাইট রোগ
এ রোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে পাতায় পানি ভেজা ক্ষত দেখা যায়।
পরে পাতার আগা পুড়ে যায়, ফল পঁচে যায় এবং ফল,কান্ড ও শাথা কাল রং ধারণ করে এবং ছত্রাকের কাল মাথাযুক্ত সাদা সাদা বর্ধিত অংশ দেখা যায় ।
আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে নষ্ট করা ।
রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি টিল্ট ২৫০ ইসি ১০-১২ দিন অন্তর ২ বার স্প্রে করা ।
সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা।
সুষম সার ব্যবহার করা।
প্রোভেক্স বা হোমাই বা বেনলেট ১% দ্বারা বীজ শোধন করা ।
বেগুনের ছত্রাকজনিত ঢলে পড়া রোগ Wilt of Brinjal (Fusarium oxysporum) ছত্রাক রোগ।
আক্রান্ত গাছের পাতা হলুদ ভাব হয়।
গাছের এক প্রান্ত ঢলে পড়ে এবং ধীরে ধীরে অন্য প্রান্ত ঢলে পড়ে।
চুড়ান্ত ভাবে সম্পূর্ণ গাছটি ঢলে পড়ে এবং শুকিয়ে যায়।
উভয় ক্ষেত্রে ভ্যাসকুলার বান্ডেল বিবর্ণ হয় এবং পচে যায়।
খাদ্য ও পানি চলাচল ব্যাহত হয়।
গাছের কিছু ডাল শুকিয়ে যায়, কিছু ডাল ভালো থাকে।
শস্য পর্যায় ক্রম অবলম্বন করা।
আক্রান্ত গাছ তুলে গর্তে পুঁতে বা পুড়ে ফেলা।
প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম ট্রাইকোডারমা ভিড়িডি বা হারজেনিয়াম মিশিয়ে ১৫-২০ মিনিট চারা শোধন করা।
চাষের পূর্বে জমিতে প্রতি শতাংশ ১-২ কেজি ডলো চুন বা পাথরের চুন ব্যবহার করা।
প্রথমে গাছ আক্রান্ত হলে কুপ্রাভিট ৪০ গ্রাম বা চ্যাম্পিয়ান- ২০ গ্রাম/১০ লিটার পানি বা বর্দ্দোমিকচার (১০০ গ্রাম পাথরের চুন আলাদা মাটির পাত্রে ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে) ব্যবহার করা।
বেগুনের ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ Wilt of Brinjal (Ralstonia solanacearum.) ব্যাকটেরিয়া রোগ।
গাছের যে কোন বয়সে এ রোগ হয়।
গাছ হঠাৎ ঢলে পড়ে।
আক্রান্ত গাছ সকালে সুস্থ আর বিকালে ঢলে পড়ে। ২/৩ দিন পর গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়।
প্রাথমিক অবস্থায় গাছের শিকড় আক্রান্ত হয় এবং পানি চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে।
কোন সময় আক্রান্ত গাছের নিচের পাতার শিরা ঝলসে যেতে পারে।
আক্রান্ত ডাল কেটে পরিস্কার পানিতে রাখলে ঘোলাটে পুঁজ বের হয়।
উচ্চ তাপমাত্র ও অধিক আর্দ্রতা রোগ আক্রমণে সহায়ক।
পীত বেগুনকে আদিজোড় হিসেবে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বেগুনের জাতে জোড় কলম করা।
আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট বা পুড়ে ফেলা।
যে জমিতে এ রোগ হয় সেখানে বেগুন, টমেটো, আলু মরিচ ফসল ২/৩ বছর চাষ না করা।
জমি তৈরীর সময় সাথে সাথে একর প্রতি ৩ কেজি কার্বোফুরান বা মিরাল মাটির সাথে মিশিয়ে বা গাছের গোড়ায় ৫ গ্রাম উল্লেখিত দানাদার ব্যবহারে এ রোগ কমে।
প্রাথমিক আক্রান্ত গাছের গোড়ায় ১% বদ্যোমিকচার বা ৪০ গ্রাম কুপ্রাভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
স্ট্রেপ্টোমাইসিন বা প্লান্টোমাইসিন এক গ্রাম ৭/১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫-২০ মিনিট চারা ডুবিয়ে রাখলে উপকার পাওয়া যায়।
চারা রোপনের ২০-২৫ দিন আগে বিঘা প্রতি ২.৬ কেজি ব্লিচিং পাউডার শেষ চাষে ব্যবহার করা।
বেগুনের শিকড়ের গিট রোগ Root Knot of Brinjal (Meloidogyne sp.) কৃমিজনিত রোগ।
আক্রমণ চারা অবস্থা থেকে শুরু হয়।
আক্রান্ত গাছ ছোট, দূর্বল ও হলদেটে রং হয়।
গাছের শিকড় অসংখ্য গিট সৃষ্টি হয় এবং গিঁটে অনেক কৃমি থাকে।
আক্রান্ত গাছের শাখা ও শিকড় নষ্ট হয়ে যায় এবং দিনে গাছ ঢলে পড়ে।
আক্রান্ত গাছ তুলে নষ্ট করা।
একই জমিতে বার বার বেগুন চাষ না করা।
শুষ্ক জমিতে চাষ দিয়ে মাটি উলটপালট করা।
কৃমি রোগ দমনের জন্য শেষ চাষে ফুরাডান ব্যবহার করা।
বেগুনের ছোট পাতা বা ক্ষুদে পাতা রোগ Little Leaf of Brinjal (Mycoplasma) মাইকোপ্লাজামাজনিত রোগ ।
আক্রান্ত গাছে ছোট ছোট অনেক পাতা হয় এবং পাতাগুলো গুচ্ছ দেখা যায়।
জ্যাসিড পোকা এ রোগ ছড়ায়।
বেগুন চাষের সময় তাপমাত্রা বাড়লে জ্যাসিড পোকার আক্রমণ বেশী হয়।
গাছের বয়স এক মাস হওয়ার পর এ রোগ দেখা যায়। তবে পূর্ণ বয়স্ক গাছে এ রোগের তীব্রতা বেশী হয়।
বেগুন পরিবারভুক্ত ফসলের চাষ কমানো।
আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়ে ফেলা।
আক্রান্ত গাছের গোড়ায় গাছ প্রতি ২৫৮ গ্রাম চুন মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে গাছ ক্রমেই সুস্থ হয়ে উঠে।
গাছের বয়স এক দেড় মাস হরে বাহক পোকা (জ্যাসিড) দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে সুমিথিয়ন ১.৫ গ্রাম, এডমায়ার ১.২ মিলি ও এমিটাফ- ২৫ মিলি মিশিয়ে স্প্রে করা।
বেগুনের পাতা ও ফলের দাগ রোগ Leaf & Fruit Spot of Brinjal (Alternaria melongenae) ছত্রাকজনিত রোগ।
আক্রান্ত পাতা বাদামী রঙের দাগ হয়।
দাগগুলো ক্রমেই সব পাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
বেশী আক্রান্ত গাছের পাতা ঝরে পড়ে।
ফলেও আক্রান্ত হয় ও ঝরে পড়ে।
ক্ষেত পরিস্কার/ পরিচ্ছন্ন রাখা।
আক্রান্ত পাতা, ডাল , কান্ড নষ্ট বা পুড়ে ফেলা।
রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা।
বীজ শোধন করা (ব্যাভিষ্টিন ২ গ্রাম/ ১ কেজি বীজ)।
আক্রমন বেশী হলে রোভরাল বা ব্যাভিষ্টিন- ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
বেগুনের গোড়া পচা বা নেতিয়ে পড়া Foot Rot or collar Rot (Sclerotium rolfsii) ছত্রাকজনিত রোগ।
গাছের যে কোন বয়সে এর রোগ দেখা যায়।
আক্রান্ত গাছ ঝিমিয়ে যাওয়াটা রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।
পাতা ফ্যাকাসে, হলুদ ও শুকিয়ে যায়।
কান্ড, শাখা, প্রশাখা শুকিয়ে সরু হয়ে যায়। গোড়া পচে যায়।
ছোট ছোট শিকড়গুলো ও পরবর্তীতে প্রধান শিকড়েও পচন ধরে।
চুড়ান্ত পর্যায়ে গাছ শুকিয়ে মারা যায়।
আক্রান্ত মরা পাতা, ডাল পুড়িয়ে ফেলা।
ভোরে বীজতলায় বা মাঠে গাছের গোড়ায় শুকনো ছাই ছিটালে ছত্রাকের আক্রমণ কম হয়।
রোগাক্রান্ত গাছের গোড়ায় শুকনো ছাই মিশ্রিত পটাশ সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে পুনরায় নতুন করে শিকড় বের হয়ে গাছ সতেজ করে।
রোগক্রান্ত হওয়ার পূর্বে ২ গ্রাম কমপ্যানিয়ন, কুপ্রাভিট- ৪ মিলি, চ্যাম্পিয়ন- ২ গ্রাম, টিল্ট- ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করলে ছত্রাকের আক্রমণ কম হয়।
বেগুনের ফল ও কান্ড পচা রোগ Fruit & Stem Rot of Brinjal (Phomopsis vexans) ছত্রাকজনিত রোগ।
বীজ, চারা, কান্ড, ডাল, পাতা, ফুল ও ফল এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয।
আক্রান্ত গাছের ডালে বা কান্ডে ক্যাংকার সৃষ্টি হয়।
ডাল চক্রাকারে পচে যায় ফলে গাছ মারা যায়।
পরবর্তীতে এ রোগ ফলেও আক্রমণ করে, কালো ক্ষতের সৃষ্টি হয় ও ফলও পচে যায়।
ক্ষেত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা।
রোগমুক্ত ক্ষেত থেকে বীজ সংগ্রহ।
একই জমিতে প্রতি বছর বেগুন চাষ না করা।
ফসল সংগ্রহ শেষে শুকনো পাতা ডাল, কান্ড, ফল ইত্যাদি সংগ্রহ পূর্বক নষ্ট বা পুড়ে ফেলা।
বীজ শোধন করা (কার্বেনডাজিম বা থিরাম-২ গ্রাম/প্রতি কেজি বীজ)।
মাঠে রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ব্যাভিষ্টিন ২ গ্রাম দিয়ে স্প্রে করা।
রোগ প্রতিরোধ জাত ব্যবহার করা যেমন যশোহর লোকাল, কাঁটা বেগুন, ঈশ্বরদী- ১ ইত্যাদি।
(তথ্য সূত্রে-plant disease clinic)