টমেটোর বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার
টমেটোর ফল ফেটে যাওয়া সমস্যা
লক্ষণঃ
তাপমাত্রার দ্রত পরিবর্তন, অতি পানি ঘাটতির পর হঠাৎ সেচ দেওয়া বা গাছের শরীরবৃত্তীয় কারণে কখনও কখনও টমেটো ফেটে যায়।
এতে টমেটো খাবারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
জমিতে নিয়মিত সেচ দেওয়া।
সুষম সার ব্যবহার করা।
সঠিক দুরত্বে চারা রোপন করা।
খরার সময় হঠাৎ জমিতে সেচ প্রয়োগ করবেন না।
আগাম বীজ বপন করা।
নিয়মিত জমির আদ্রতা পরীক্ষা করে সেচ দিন।
টমেটোর বাক আই রোগ
মাটির কাছাকাছি থাকা ফলের নিচের দিকে প্রথমে পঁচা শুরু হয় এবং ক্রমশ তা উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আক্রান্ত স্থান মসৃণ হয় এবং গাঢ় বাদমি ও হালকা বাদামি রঙ্গের ব্যান্ড দেখা যায়।
রোগমুক্ত এলাকা হতে সুস্থ বীজ সংগ্রহ করা ।
সুস্থ, সবল ও রোগ সহনশীল জাত চাষ করা ।
পরিমিত সার ব্যবহার ও সেচ প্রয়োগ করা ।
শস্য পর্যায়ক্রম অনুসরণ করা ।
রোগের অনুকুল পূর্বাভাস পাওয়া মাত্র প্রতিরোধক হিসাবে ২ গ্রাম ম্যানকোজেব + মেটালেক্সিল (রিডোমিল গোল্ড, করমি, মেটারিল) জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা রোগের আক্রমণ বেশী হলে প্রতি লিটার পানিতে-২ গ্রাম সিকিউর মিশিয়ে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায় ।
টমেটোর ব্লোজম ইন্ড রট রোগ
পুষ্টি গ্রহন ক্ষমতা অপর্যাপ্ত হয় এবং ক্যালসিয়াম ট্রান্সলোকেশন কম হয় তখন এই রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায় ।
অনেক সময় ফলের প্রান্তে পানিভেজা দাগের সৃষ্টি হয়ে ক্রামান্বয়ে কালচে রং ধারণ করে ।
মাটির আদ্রতা রক্ষার জন্য মালচিং করা বা খড়, শুকনা কচুরিপানা ইত্যাদি দিয়ে মাটি ঢেকে দেয়া ।
পরিমিত ও সময়মত সুষম সার ও সেচ প্রয়োগ করা ।
লাল মাটি বা অম্লীয় মাটির ক্ষেত্রে শতাংশ প্রতি চার কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
টমেটো হোয়াইট মোল্ড রোগ
ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ হয়।
এতে পাতার বোটায়, কান্ডে ও ফলে সাদা তুলার মত বস্তু দেখা যায় ।
এটি টমেটোর কোন মারাত্বক রোগ নয়।
প্লাবন সেচের পরিবর্তে স্প্রিংলার সেচ দেয়া।
আক্রান্ত ফল,পাতা ও ডগা অপসারণ করা।
বীজ লাগানোর আগে গভীরভাবে চাষ দিয়ে জমি তৈরী করা ।
প্রপিকোনাজলগ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মি.লি. / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করা।
টমেটোর চারা ধ্বসা রোগ
আক্রান্ত চারার গোড়ার চারদিকে দাগ দেখা যায় ।
গোড়ার সাদা ছত্রাকজালি ও অনেক সময় সরিষার মত ছত্রাকের অনুবীজ পাওয়া যায় ।
শিকড় পচে যায়, চারা নেতিয়ে পড়ে গাছ মারা যায় ।
স্যাতস্যাতে মাটি ও মাটির উপরিভাগ শক্ত হলে রোগের প্রকোপ বাড়ে ।
রোগটি মাটিবাহিত বিধায় মাটি, আক্রান্ত চারা ও পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে ।
বীজতলায় শুকনো কাঠের গুড়া পোড়ানো/ সরিষার খৈল ৩০০ কেজি/ হেঃ অথবা মাটি সোলারাইজেশন করা । বীজতলায় হেঃ প্রতি ২.০ টন ট্রাইকো-কম্পোস্ট ব্যবহার করা ।
আগাম বীজ বপন করা।
সুষম সার ব্যবহার করা।
সঠিক দুরত্বে চারা রোপন করা।
টমেটোর পাতা কোকড়ানো বা লিফ কার্ল রোগ Leaf Curl of Tomato
রোগের কারণঃ
Tomato Yellow Leaf Curl Virus (TYLCV) এর আক্রমণে এ রোগ হয়।
সাদা মাছি দ্বারা ভাইরাস ছড়ায়।
আক্রান্ত গাছ খর্বাকৃতি হয়।
পাতার গায়ে ঢেউয়ের মত ভাজের সৃষ্টি হয় ও পাতা ভীষণ ভাবে কোঁকড়ায়ে যায়।
বয়স্ক পাতা পুরু মচমচে হয়ে যায়।
আক্রমণ বেশী হলে পাতা মরে যায়।
গাছে অতিরিক্ত শাখা প্রশাখা বের হয় এবং ফুল ও ফল ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
পাতার কিনারা থেকে মধ্যশিরার দিকে গুটিয়ে যায়।
পাতা খসখসে হয়ে শিরাগুলো স্বচ্ছ হলুদ হয়ে কুঁকড়িয়ে যায় এবং পাতা গুলো পীতবর্ণ ধারণ করে।
আক্রান্ত গাছের ডগার পাতাগুলো ছোট ছোট গুচ্ছাকার ধারণ করে।
গাছ খর্বাকৃতির হয় ও ফল ছোট হয়।
আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে ধ্বংস করা।
রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত ব্যবহার করা।
ভাইরোসের বাহক পোকা (সাদা মাছি) দমনের জন্য ডাইয়মেথোয়েট (পারফেকথিয়ন), এসাটাফ, এডমায়ার, টিডো ইত্যাদি যে কোন একটি বালাইনাশক ব্যবহার করা।
ছোট ছিদ্রযুক্ত নাইলনের নেট দিয়ে বীজতলা ঢেকে চারা উৎপাদন করা।
চারা লাগানোর এক সপ্তাহ পর থেকে ফল আসা পর্যন্ত ১২ দিন পরপর কমপক্ষে ২ বার যে কোন কীটনাশক যেমন এ্যাডমায়ার (প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ মিলি) প্রয়োগ করে সাদা মাছি দমন করা।
প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত গাছ উঠিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা।
জমি আগাছা মুক্ত রাখা।
টমেটোর শিকড়ে গিট কৃমি/রুট নট নেমাটোড রোগ
রোগের কারণঃ Meloidogyne incognita ও Meloidogyne javanica নামক কৃমি দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
গাছ বৃদ্ধির শুরুতে কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হলে এবং আক্রমণের ব্যাপকতা বেশী হলে গাছ নিস্তেজ ও খাটো হয়ে যায়।
পাতাগুলো হলদে সবুজ হতে হলুদ রঙের হয়। অনেক ক্ষেত্রেই পাতা হঠাৎ করে ঝরে পড়ে।
এ রোগ চেনার সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো গাছ তুললে শিকড়ে অসংখ্য ছোট বড় গিঁট দেখা যায়।
সাধারণত আক্রান্ত স্থলের কোষের আকার খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে গিঁট বা নটের সৃষ্টির হয়।
গাছে ফুল ধরার ক্ষমতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় এবং ফলে ধরে না বললেই চলে।
হেক্টরপ্রতি ৫ টন অর্ধপচা মুরগির বিষ্ঠা চারা লাগানোর কমপক্ষে ২১ দিন আগে জমিতে প্রয়োগ করা এবং সেচের মাধ্যমে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দেয়া।
মাটিতে স্টেবল ব্লিচিং পাউডার ২০ কেজি/ হেক্টর হারে জমির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা।
ফুরাডান ৫ জি নামক কৃমিনাশক ২৫ কেজি/হেক্টর হারে চারা লাগানোর সময় অথবা জমির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করা।
টমেটোর বুশি স্টান্ট রোগ (Bushy Stunt of Tomato) ভাইরাসজনিত রোগ।
লিফ হোপার নামক পোকা দ্বারা ভাইরাস ছড়ায়।
গাছের উাপরের অংশ কুঁকড়ায়ে যায়। পাতা মুড়িয়ে যায় ও চামড়ার ন্যায় পুরু মনে হয়।
আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে ধ্বংস করা।
রোগমুক্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত ব্যবহার করা।
ভাইরোসের বাহক পোকা (সাদা মাছি) দমনের জন্য ডাইয়মেথোয়েট (পারফেকথিয়ন), এসাটাফ, এডমায়ার, টিডো ইত্যাদি যে কোন একটি বালাইনাশক ব্যবহার করা।
টমেটোর ব্যাক্টেরিয়াল উইল্ট বা ঢলে পড়া রোগ Bacterial Wilt of Tomato
রোগের কারণঃ Ralstonia solanaciarum
ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট একটি মাটিবাহিত রোগ।
এ রোগের জীবাণু শিকড়ের ক্ষতস্থান দিয়ে গাছে প্রবেশ করে এবং পানি-পরিবহন নালীর মধ্যে বংশ বিস্তার করে নালী পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে পাতা ও গাছ সবুজ অবস্থায় নেতিয়ে বা ঢলে পড়ে।
এভাবে কয়েক দিনের মধ্যে সবুজ অবস্থাতেই গাছটি মরে যায়।
রোগাক্রান্ত গাছের কান্ড মাটি থেকে ১-২ ইঞ্চি উপরে ছুরি দিয়ে কেটে পরিষ্কার কাঁচের গ্লাসের পানিতে রাখলে ২-৩ মিনট পরেই সাদা সূঁতার মতো পুঁজ বের হয়ে আসতে দেখা যায়। এ পদ্ধতিটি দ্বারা সহজেই এ রোগের জীবাণুকে সনাক্ত করা যায়।
রোগাক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে ধ্বংস করা।
শস্য পর্যায়ক্রম করা যেমন ভুট্টা, সরিষা, গম।
রোগ সহনশীল জাত চাষ করা।
পরিমিত সেচ প্রদান। এ রোগ ধরে গেলে সেচ বন্ধ করা।
বীজ ও চারা শোধন করা (স্ট্রেপ্টোসাইক্লিন বা স্ট্রেপ্টোমাইসিন বা প্লান্টোমাইসিন ১ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করা যেতে পারে।
হেক্টর প্রতি ৫ টন অর্ধপচা মুরগির বিষ্ঠা লাগানোর কমপক্ষে ২১ দিন আগে জমিতে প্রয়োগ করে মিশিয়ে দেয়া এবং মাটির সাথে ভালভাবে পচাতে হবে।
সরিষার খৈল ৫০০ কেজি/হেক্টর হারে জমির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।
ফুরাডান ৫ জি নামক কৃমিনাশক ২৫ কেজি/হেক্টর হারে চারা লাগানোর সময় অথবা জমির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করলে টমেটোর ঢলে পড়া রোগ এবং শিকড়ে গিঁট কৃমি বা রুট নট নেমাটোড স্বার্থক ভাবে দমন করা যায়।
টমেটোর আগাম ধ্বসা বা আর্লি ব্লাইট রোগ Early Blight of Tomato
রোগের কারণঃ Alternaria solani নামক ছত্রাক দ্বারা এই রোগ হয়।
এই রোগটি বীজবাহিত এবং এ রোগের জীবাণু মাটিতে ও আগাছার মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে। পরে সেখান থেকে বাতাস, পানি ইত্যাদির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
এ রোগের আক্রমণে টমেটোর চারা মরে যায় এবং পাতা ও ফল ঝরে পড়ে।
তুলনামূলক ভাবে বর্ধনশীল বয়স্ক গাছেই এ রোগ বেশী দেখা যায়।
আক্রান্ত বীজ থেকে চারার বীজপত্রে প্রথমে গাঢ় রঙের ছোট ছোট দাগ পড়ে। পরে তা কা- ও পাতায় ছড়িয়ে যায়। শেষে চারা মরে যায়।
বয়স্ক গাছের পাতায় প্রথমে বৃত্তাকার দাগ বা এককেন্দ্রিক বলয়ের মত গাঢ় দাগ পড়ে।
ফলেও অনুরূপ কুঁচকানো বাদামী থেকে কালো রঙের বয়লাকৃতি দাগ সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ফল পাকার আগেই ঝরে পড়ে।
প্রোভে বা ভিটাভে -২০০ (প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম) দিযে শোধন করে বীজ বপন করা।
যেখানে এ রোগ নিয়মিত ও বেশী হয় সেখানে রোপন সময় পরিবর্তন করে সম্ভব হলে শুষ্ক মৌসুমে এই ফসল চাষ করা।
রোগমুক্ত গাছ বা উৎস থেকে সংগৃহীত বীজ ব্যবহার করা।
শস্য পর্যায় অবলম্বন করা।
পাতা বেশী সময় ধরে ভেজা থাকলে এ রোগের জীবাণু বৃদ্ধি পায়। তাই ঝরনা সেচ না দেয়া।
অনুমোদিত ছত্রাক নাশক যেমন- রোভরাল ২ গ্রাম ১ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে সঠিক নিয়মে ১৫ দিন অন্তর স্প্রে করা।
টমেটোর নাবী ধ্বসা রোগ Late Blight of Tomato (Phytophthora infestans) ছত্রাক রোগ।
পাতার উপরে ফ্যাকাশে অথবা ফিকে সবুজ রঙের গোলাকার অথবা এলোমেলা পানি ভেজা দাগ পড়ে।
কুয়াশাচ্ছন্ন ও মেগলা আবহাওয়ায় দাগ সংখ্যা ও আকার দ্রুত বাড়তে থাকে।
বাদামী থেকে কালচে রং ধারণ করে।
রোগের আক্রমণ বেশী হলে গািেছর কান্ড ও সবুজ ফলেও রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার ৩-৪ দিনের মধ্যে গাছ ঝলসে যায় ও দ্রুত মহমারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
রোগমুক্ত এলাকা হতে সুস্থ বীজ সংগ্রহ করা।
সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত চারা রোপন করা।
রোগ সহনশীল জাত চাষ করা যেমন মানিক, রতন।
পরিমিত সার ব্যবহার ও সেচ প্রয়োগ করা।
শস্য পর্যায়ক্রম অনুসরণ করা।
রোগের অনুকুল পূর্বাভাস পাওয়া মাত্র প্রতিরোধকেক হিসাবে ২ গ্রাম ম্যানকোজেব + মেটালেক্সিল (রিডোমিল গোল্ড, করমিল, মেটারিল) জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।
রোগের আক্রমণ বেশী হলে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম সিকিউর মিশিয়ে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
(তথ্য সূত্রে-plant disease clinic SAU)